11.4.12
নীল টুনি
এরা দুর্গাটুনটুনি, বেগুনটুনি, মধুচুষকি নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Purple Sunbird এবং বৈজ্ঞানিক নাম Cinnyris asiaticus। টুনি একরত্তি পাখি। ঠোঁটের ডগা থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত মাত্র ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, যার মধ্যে শুধু ঠোঁটটিই ৪ সেন্টিমিটার। রঙের কী বাহার! দূর থেকে পুরুষ পাখি বা নীল টোনাকে একদম কালো দেখায়। কিন্তু কাছে এলে বোঝা যায়, এর রং গাঢ় নীল। রোদ লাগলে তা দেখায় উজ্জ্বল ধাতব বেগুনি-নীল। মাথা-পিঠ ধাতব বেগুনি; বুক বেগুনি-কালো। বুক ও পেটের মাঝখানে পিঙ্গল ও লালচে রিং থাকে। কালো যে কত সুন্দর হতে পারে, তা টোনাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। তবে এই রূপ শুধু বাসা বাঁধা ও ডিম পাড়ার মৌসুমেই। ছানারা বাসা ছেড়ে উড়ে যাওয়ার পর থেকে এই নীলচে বেগুনি ও কালো রং আস্তে আস্তে ফ্যাকাশে হতে থাকে। টোনা এত সুন্দর হলেও টুনি ততটা সুন্দর নয়। টুনির পিঠ হলুদাভ বাদামি। নিচের অংশ হালকা হলুদাভ। লেজ ধূসর কালো।নীল টোনা গানের পাখি। চমৎকার সুরে গান গায়। ভোরে সব পাখির আগে এরা মধুর কণ্ঠে ঘুমভাঙানি গান গেয়ে ওঠে। টোনা মিষ্টিমধুর চি-হুইট-চি-হুইট-চি-হুইট স্বরে গান করে। টুনি সাধারণত নীরব, স্বরও বেশ কর্কশ।
হামিং বার্ডের মতো এরাও বাতাসে স্থির থেকে উড়তে পারে। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো এগাছে-ওগাছে, এ ফুল থেকে ও ফুলে উড়ে উড়ে মধু পান করে। খুব চঞ্চল। ফুলের বোঁটার ওপর বসে বাদুড়ের মতো ঝুলে পড়ে মধু পান করে। মধুর অভাবে ছোট ছোট পোকামাকড়ও খেতে পারে।
শীত ও বসন্তেই প্রধানত বাসা বানায় এবং ডিম পাড়ে। সাধারণত গেরস্তবাড়ির আঙিনায় বরই বা ডালিমগাছের চিকন ঝুলে পড়া ডালে বা লাউ-শিমের লতানো গাছের ডগায় বাসা বাঁধে। গেরস্তবাড়ির আশপাশ ছাড়া এরা বাসা বাঁধতেই চায় না। মানুষের সান্নিধ্য চাই-ই চাই। তবু সচরাচর তা চোখে পড়ে না, তার কারণ হঠাৎ দেখলে বাসাটাকে ঝোপ-জঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতেই এ ধরনের ছদ্মবেশী বাসা।
এদের বাসার গড়ন ও সাজসজ্জায় রুচি ও বিলাসের ছাপ স্পষ্ট। সৌন্দর্য ও প্রকৌশলগুণে বাবুইয়ের পরই এদের বাসার স্থান। বাসাটা দেখতে অনেকটা থলের মতো। মাকড়সার জাল দিয়ে এর ভিত রচনা করা হয়। প্রবেশপথ ওপরের দিকে। প্রবেশপথের মুখের ওপর সানশেডের মতো থাকে। বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্যই হয়তো এ ব্যবস্থা। বাসায় ডিম ও বাচ্চা রক্ষার জন্যও সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। এরা বাসার ওপর ফুলের পাপড়ি মাকড়সার আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়। ভেতরে ডিম রাখার জন্য থাকে কোমল বিছানা। বাসাটি ঝোপঝাড়-লতার সঙ্গে ভালোভাবে আটকানো থাকে, বাতাসে দোলে। বাতাসের সময় ভারসাম্য রক্ষার জন্য নিচের দিকে মাকড়সার জাল ও লতাপাতা সুতোর মতো ঝোলানো থাকে।
নীল টুনি প্রতি মৌসুমে নতুন বাসা বানায়। তবে বাসা শক্তপোক্ত থাকলে দু-তিনবারও ব্যবহার করতে পারে। আমার বাসার কাঁঠালগাছে একবার এমনটি ঘটেছিল। বাসার জায়গা পছন্দ করা এবং বাসা তৈরির পুরো দায়িত্ব টুনির। টোনা মাঝে মাঝে এসে কাজ তদারক করে এবং আনন্দে গান গায়। টুনি দু-তিনটি ধূসর বা সবুজাভ সাদা ডিম পাড়ে। এর ওপর থাকে বাদামি ছোপ। টুনি বাসায় বসে যখন ডিমে তা দেয়, তার লম্বা ছুঁচালো ঠোঁটটি দরজার মুখে বেরিয়ে থাকে। টোনা কখনোই ডিমে তা দেয় না। ডিম ফোটে ১৪-১৫ দিনে। তখন টোনার কী আনন্দ! ক্ষণে ক্ষণে ডাকতে থাকে। টোনা-টুনি উভয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়। ছানা ১৬-১৭ দিনে বড় হয় এবং বাসা ছাড়ে। বাসা ছাড়ার পরও এরা সপ্তাহ দুয়েক বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। একসময় নিজেরাই ঘর বাঁধে। নীল টুনিরা আট থেকে ১২ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
আ ন ম আমিনুর রহমান | | প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment