পাখি পর্যবেক্ষণ
পাখি পর্যবেক্ষণ বা Bird Watching খুব উপভোগ্য ও মজাদার শখ হিসাবে সারা পৃথিবীতেই অনেক জনপ্রিয় একটি বিষয়। প্রকৃতিবিদ ও পাখি প্রেমিকদের কাছে এই পাখি পর্যবেক্ষণ একটি অতি পরিচিত শব্দ। পক্ষী বিশারদ সালীম আলী যাকে ভারত সরকার পদ্মভূষণে ভূষিত করা হয়েছিল তার নাম শোনেন নাই এই রকম মানুষ খুব কমই আছেন। সালীম আলী পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ সহ সমগ্র ভারতবর্ষ এবং পাখি বিষয়ে রচনা করেছেন অনেক বই। তিনি পাখিকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে আমৃত্যু কাজ করেছেন। বাংলাদেশের পাখি পর্যবেক্ষকদের কথা বললে সর্বপ্রথম আসে ইনাম আল হকের নাম। তিনি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে পাখি পর্যবেক্ষণকে বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় করে তৈরি করেছেন অনেক পাখি পর্যবেক্ষক।
উপকরনঃ
পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হল বাইনোকুলার, ফিল্ড-গাইড, নোটবুক ও পেন্সিল। বাংলাদেশের বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় ভাল মানের কিছু বাইনোকুলার পাওয়া যায় বলে শুনেছি। অধিকাংশের মতে পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য এই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ভাল ফিল্ড-গাইড হল রিচার্ড গ্রিমেট, ক্যারল ইন্সকিপ ও টিম ইন্সকিপ এর ‘পকেট গাইড টু দা বার্ডস অব ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট’ বইটা। গতবছর বাংলাদেশের পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য রোনাল্ড আর হালদার ‘এ ফটোগ্রাফিক গাইড টু বার্ডস অব বাংলাদেশ’ নামে একটি বই বের করেন। ৭৩৫টি ফটোগ্রাফসহ মোট ৪৭২টি পাখির বাংলা, ইংরেজি, বৈজ্ঞানিক নামসহ এই বইটি ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এই সকল উপকরণ ছাড়াও পাখি পর্যবেক্ষণ করতে যাওয়ার সময় পকেটযুক্ত হালকা ওজনের গাঢ় রঙের জামা, টাউজার ও ক্যাপ পরতে হবে। জঙ্গলের ক্ষতিকর পোকামাকড় জোঁক, সাপ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য জঙ্গল বুট আদর্শ হতে পারে। সঙ্গে শুকনা খাবার পানির বোতল রাখা আবশ্যক।
কলাকৌশলঃ
পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য অবশ্যই সেই প্রাকৃতিক পরিবেশে যেতে হবে যেখানে পাখিরা থাকে। যেই এলাকাতে পাখি পর্যবেক্ষণে যাওয়া হবে সেখানকার বাস্তুসংস্থান এবং সেই অঞ্চলের পাখিদের চেকলিস্ট সংগ্রহ করে সেই পাখি সম্পর্কে যেমন সেখানে কি কি পাখি পাওয়া যায়, পাখিদের আচরণ, বাসস্থান ও স্বভাব সম্পর্কে ভাল ধারনা নিয়ে যাওয়া উচিত। সূর্যকে পাখির বিপরীত দিকে রেখে পাখি দেখতে হবে যাতে সূর্য আপনার পিছনে এবং আপনার ছায়া পাখি ও আপনার মাঝখানে থাকে এতে পাখির রঙ ও পাখির সবকিছু বিস্তারিতভাবে দেখা যাবে। আর পাখি পর্যবেক্ষণ করার সময় অবশ্যই নিশ্চুপ ও যতটুকু সম্ভব নিঃশব্দে চলাফেরা করতে হবে এতে পাখি চমকে উড়ে যাওয়ার আগেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। প্রথমেই বাইনোকুলার ব্যাবহার করা যাবে না, খালি চোখে পাখির অবস্থানকে নিশ্চিত করে তারপর বাইনোকুলার ব্যাবহার করতে হবে পাখিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখার জন্য এবং কোন প্রজাতির পাখি তা শনাক্ত করার জন্য।
নীতিমালা:
১) পাখি পর্যবেক্ষণের সময়টুকু একদম নিশ্চুপ থাকতে হবে। যে কোন প্রকার কোলাহল সৃষ্টিকরা ও পাখিকে বিরক্ত করা যাবে না।
২) পাখির প্রজনন ঋতুতে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই সময় একটু বিরক্তি তাদের প্রজননকে ব্যাহত করতে পারে।
৩) পাখির নীড় দেখতে পেলে ভিতরে বাচ্চা বা ডিম আছে কিনা তা দেখার জন্য কাছে যাওয়া, পাখির ডিম বা বাচ্চা হাত দিয়ে ধরা একেবারেই নিষিদ্ধ।
৪) জাতীয় উদ্যান বা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের সকল নিয়মকানুন জানা ও মানার চেষ্টা করতে হবে।
৫) অধিক মানুষ একসাথে বড় দলে পাখি পর্যবেক্ষণে যাওয়া যাবে না। দল বড় হলে ছোট ছোট অনেকগুলি দল গঠন করে বনে বা জঙ্গলে ঢুকতে হবে।
৬) বনে কোন ময়লা, আবর্জনা বা খাবার ফেলা যাবে না কারণ পাখি এই ফেলে দেওয়া ময়লা বা খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যেতে পারে।
পাখি পর্যবেক্ষণে পাখি সনাক্ত করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতিতে একটি পাখি দেখার পর সেটিকে সনাক্ত করার ক্ষমতার উপরই পাখি পর্যবেক্ষকদের দক্ষতা নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় দশ হাজার প্রজাতির পাখি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এত বিপুল সংখ্যক পাখির মধ্যে একটি পাখি দেখার পর তা চিনতে পারা ও মনে রাখা খুবই কষ্টের ব্যাপার।
পাখি সনাক্ত করার জন্য কয়েকটি বিষয় জরুরী বা অত্যাবশ্যকীয়। তাদেরকে পাখি চিনার চাবিকাঠি ও বলা যেতে পারে। যেমন:
১) আকার ও আকৃতি
২) বর্ণ বিন্যাস বা রঙ
৩) আচরণ
৪) বাসস্থান বা আবাসস্থল
৫) বিশেষ চিহ্ন বা দাগ
৬) ডাক ও গান বা শব্দ
১) আকার ও আকৃতি: খুব অল্প অনুশীলন করেও পাখিদের আকার ও আকৃতির পার্থক্য সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। একটি চরই, শালিক এবং কবুতরের আকার নিশ্চয়ই এক নয়। তেমনি একটি শালিক ও বুলবুলির আকৃতিও এক নয়। পাখির আকার ও আকৃতির সমন্বয় হল পাখি সনাক্ত করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপকরণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বক বা মাছরাঙা পাখিটি তাদের দেহের আকার আকৃতি দেখেই সনাক্ত করা সম্ভব। আকার আকৃতির পার্থক্য শুধু দৈহিক ক্ষেত্রে নয় পাখির বিভিন্ন অঙ্গ যেমন ঠোট, পা, পালক এই সকল কিছুতেই প্রজাতিভেদে আকার আকৃতির ভিন্ন পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন ধনেশ পাখির ঠোট ও কাকের ঠোঁটের আকার ও আকৃতিতে রয়েছে বিরাট পার্থক্য।
২) বর্ণ বিন্যাস বা রঙ: পাখিরা মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় তাদের বাহারি রঙের জন্য। কালো কাক, সাদা বক, সবুজ টিয়া তাদের রঙেরই কথাই মনে করিয়ে দেয়। পাখি সনাক্ত করার জন্য পাখিদের বিভিন্ন রঙ বা বর্ণ খুবই শক্তিশালী উপকরণ। আমাদের দেশের পাতি মাছরাঙা ও পাকরা মাছরাঙা এই দুইটির রঙ সম্পূর্ণ ভিন্ন যদিও আকার ও আকৃতিতে যথেষ্ট মিল রয়েছে। এই বর্ণ বিন্যাস বা রঙের পার্থক্য ঠোট, পা, বুক, পিঠ, লেজ সহ অন্যান্য অঙ্গেও লক্ষ করা যায়।
৩) আচরনঃ পাখিদের বিভিন্ন আচরণ দেখেও পাখিদের সনাক্ত করা আরেকটি শক্তিশালী উপায়। সনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন আচরণের মধ্যে পাখির অঙ্গস্থিতি, অঙ্গভঙ্গি, বসা বা উড়ার ধরন সর্বপ্রথমে আসে। হাঁস, কাঠঠোকরা, চরই, কাক এদের বসার ভঙ্গি ভিন্নরকম। তারপর পাখিদের চলাফেরার ভঙ্গি, উড়ার ভঙ্গি, খাদ্যগ্রহণ করার প্রকৃতিও খাবারের ভিন্নতাও পাখিদের সনাক্ত করতে অনেক সাহায্য করে। কিছু পাখি একা একা উড়ে কিছু পাখি দলবদ্ধভাবে উড়ে এই আচরণ দেখেও পাখি সনাক্ত করা যায়।
৪) বাসস্থান বা আবাসস্থলঃ পাখিদের আবাসস্থল বা বাসস্থানও পাখিদের সনাক্ত করা আরেকটি নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী উপায়। কোন কোন পাখি জঙ্গলে বাস করে কোনটা আবার জলাশয়ে কোন পাখি আবার পাওয়া যায় নদীতে কোনটা আবার সমুদ্রে এমনকি বরফ ঢাকা মেরু অঞ্চলেও কিছু পাখি পাওয়া যায়। কোন পাখি বাসা বানায় মাটিতে গর্ত করে আবার কোনটা বাসা বানায় গাছে গর্ত করে। যেমন সুইচোরা পাখি মাটিতে গর্ত করে বাসা বানালেও পেঁচা গাছের গর্তে বাসা বানায় ঠিক তেমনি বাবুই পাখির কারুকার্যময় আসাধারন সুন্দর বাসা দেখেই সবাই বলে উঠবে এটি বাবুই পাখি।
৫) বিশেষ চিহ্ন বা দাগঃ পাখি সনাক্ত করার জন্য উপরে যে কয়েকটি উপকরণ এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা দিয়ে একদম সঠিক প্রজাতির পাখি সনাক্ত করা সম্ভব নয় তবে পাখিদের একটা গ্রুপ বা সংক্ষিপ্ত তালিকায় যাওয়া সম্ভব। মাঠ পর্যায়ে একটা বিশেষ চিহ্ন খুঁজে সেই পাখিকে সনাক্ত করতে হয়। এটা হতে পারে কোন রঙ্গের বিন্যাস, বিশেষ কোন দাগ, বিশেষ কোন গঠন ইত্যাদি।
উদাহরণ স্বরূপ কোন পাখির মাথায় কি কি বিশেষ চিহ্ন বা দাগের ভিন্নতা বা পার্থক্য থাকতে পারে একটু দেখি;
১) চোখের উপরের দাগ বা রঙ
২) চোখের নীচের দাগ বা রঙ
৩) জুলফি বা গোঁফ দাগ বা রঙ
৪) ঠোটের নীচ বা গলার দাগ ও রঙ
৫) উপরের ঠোঁট ও নীচের ঠোঁটের গঠন ও রঙ
৬) ঠোঁট ও চোখের মাঝখানের দাগ বা রঙ
৭) চোখের চারপাশের রঙ
৮) চোখের রঙ
৯) মাথায় ঝুঁটি আছে কিনা
১০) মাথার মাঝখানের রঙ
এমনি করে পাখির পা, পাখির ডানা ও দেহের অন্য অংশেও বিশেষ চিহ্ন, দাগ বা রঙ দেখে পাখি শনাক্ত করতে হবে। এর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। বুকের পালকের সাদা রঙের জন্য এই মাছ রাঙার নামই হয়েছে সাদা বুক মাছরাঙা।
৬) ডাক ও গান বা শব্দ: একটি কথা আছে কাক কোকিল একই বর্ণ স্বরে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। পাখির ডাক শুনে খুব অল্প সময়ে পাখিকে নির্ভুলভাবে সনাক্ত করা সম্ভব। বিশেষ করে রাতে বা দৃষ্টির আড়ালে থাকার কারণে যখন পাখি দেখতে পাওয়া তখন পাখির ডাক বা শব্দ শুনে পাখিকে সনাক্ত করতে হয়। রাতে প্যাঁচার ডাক শুনে অভিজ্ঞ পাখি পর্যবেক্ষকরা বলে দিতে পারে এটা কোন প্রজাতির প্যাঁচা তেমনি রাতচরা পাখির অনবরত ডাক শুনেও বলে দিতে পারে এটা কোন রাতচরা পাখি। বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে অনেক পাখির ডাক ও শব্দ ডাওনলোড করে শুনা যায়।
তবে পাখি সনাক্তকরণের জন্য অভিজ্ঞ পাখি পর্যবেক্ষকদের সাথে মাঠ পর্যায়ে পাখি দেখার বিকল্প নাই। বারংবার চর্চা করার ফলে পাখি সনাক্তকরণের উপর দক্ষতা অর্জিত হয়।
পাখির পালক রহস্য
যদি প্রশ্ন করা হয় পাখি কাদের বলা হয় অর্থাৎ কোন শ্রেণীর প্রাণীরা পাখি? উত্তরে অধিকাংশ মানুষই বলে থাকে যারা উড়তে পারে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। অনেক পাখি আছে যারা উড়তে পারে না যেমনঃ উট পাখি। আবার অনেক প্রাণী আছে যারা পাখির মতো উড়তে পারলেও পাখি নয় যেমন বাদুর।
উড়তে পারুক আর নাই পারুক সকল পাখির ক্ষেত্রে একই সত্য হল তাদের দেহে পালক থাকবে। পাখিদের দেহের সকল পালক এক রকমের হয়না। প্রায় ৫ প্রকারের পালক দ্বারা পাখির দেহ আবৃত থাকে।
১) Contour feather: এই পালক শক্ত হয়ে থাকে। পালকের Vane সমূহ শক্তভাবে বুনা থাকে বলে বাতাস আটকে রাখতে পারে। এই প্রকার পালক দেহের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম হয়। ডানায় ও লেজের Contour feather এদের উড়তে সাহায্য করে। অন্যান্য স্থানের Contour feather দেহকে আবৃত করে রাখে।
২) Plumule feather: এই প্রকারের পালকের Vane আলগা থাকে এবং raches বা দণ্ডের সাথে আটকানো থাকে। পাখির দেহে Contour feather এর নীচে এই প্রকার পালকের অবস্থান।
৩) Down feather: এরাও Plumule feather এর মতো তবে এদের raches বা দণ্ড ছোট থাকে তাই Vane গুলি মাথায় থোকার মতো আটকান থাকে। মুরগির ছোট ছোট বাচ্চার দেহে এই ধরনের পালক সহজে চোখে পড়ে।
৪) Filoplume feather: ময়ুরের লম্বা পালকগুলি হল Filoplume পালক। এই ধরনের পালক সব পাখির মধ্যেই আছে তবে ছোট ছোট। raches বা দণ্ড ের মাথায় vane থাকে।
৫) Bristle feather: পাখির ঠোঁট ও চোখের পাশে এই প্রকার পালক দেখা যায়। এদের raches বা দণ্ডের একদম গোড়ায় কিছু vane থাকে কিন্তু উপরের দিকে খালি। ছবিঃ ইন্টারনেট
লেখকঃ মাইন রানা
তথ্য ও ছবিঃ ইন্টারনেট