29.4.11

দেশি নীল রবিন

মিরপুর চিড়িয়াখানাসংলগ্ন জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে বাংলাদেশের অতিবিরল পাখি ‘দেশি নীল রবিন’ দেখা গেছে। প্রায় ২০ বছর আগে পাখি পর্যবেক্ষক পল টমসনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বিরল প্রাণীর তালিকায় পাখিটির নাম যুক্ত হয়। তিনিই আবার ২০০৩ সালে পাখিটিকে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রথম দেখেন; যদিও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের খুব কম পর্যবেক্ষকেরই ভাগ্য হয়েছে পাখিটি দেখার। এ দেশে কালেভদ্রে দেখা মেলে বলে পাখিপ্রেমীদের কাছে দেশি নীল রবিন ভিআইপি পাখি বলেই গণ্য হয়ে আসছে। এখন উদ্ভিদ উদ্যানের বাঁশঝাড়ে পাখিটি দেখতে পেয়ে পাখিপ্রেমীরা নিজেদের মহাভাগ্যবান মনে করছেন।

আকারে ও ওজনে দেশি নীল রবিন আমাদের জাতীয় পাখি ‘ম্যাগপাই-রবিন’ বা দোয়েলের চেয়ে কিছুটা ছোট; দৈর্ঘ্য ছয় ইঞ্চি, ওজন ১৮ গ্রাম। তবে এ খুদে পাখিটি দোয়েলের মতো বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা নয়, শীতের আগন্তুক। এর পালকের রং দোয়েলের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়; পুরুষ পাখির পিঠ মোলায়েম নীল, পেট কমলা আর চোখের ওপর স্পষ্ট সাদা ভ্রু-রেখা। স্ত্রী পাখির শরীর পুরোটাই কিন্তু সাদামাটা খয়েরি পালকে মোড়া; নীল রবিন নাম সমুন্নত রাখার মতো নীলের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই।
দেশি নীল রবিন মূলত হিমালয়ের পাখি; হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে চীন পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। গ্রীষ্মে পাহাড়ের ঢালে এ পাখি মাটিতে শেওলার বাসা বানিয়ে তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। পাহাড়ে বরফ নামার আগেই ছানাসহ এরা দক্ষিণের সমতলে নেমে আসে। শীত মৌসুমে সমতলভূমিতে এরা ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাটিতে হেঁটে পোকামাকড় শিকার করে। হিমালয়ী বনে গ্রীষ্মের আস্তানায় যাওয়ার পথে ভাগ্যক্রমে আমাদের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এক জোড়া দেশি নীল রবিন এবার অস্থায়ী আস্তানা গড়েছে। বাঁশঝাড় ও এর আশপাশে নিশ্চল বসে থাকলে এদের সন্তর্পণে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়। তবে বেশি মানুষের সমাগম হলেই অতি সতর্ক এ পাখি ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দেয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট রেসিডেন্ট’ হিসেবে নেপালে থাকার সময় পাখিবিদ ব্রায়ান হজসন ১৮৩৭ সালে দেশি নীল রবিন পাখিটি প্রথম শনাক্ত করেন। তিনি ভারতবর্ষের আরও ৭৮টি নতুন পাখি শনাক্ত করেছিলেন। অক্লান্ত এ পাখিবিদের নামেই বাংলাদেশের দুটি পাখির নামকরণ করা হয়েছে: ‘হজসনি চোখ গেল’ ও ‘হজসনি ব্যাঙমুখো’। পাখিবিদ হজসনের দেওয়া নাম কিছুটা পরিবর্তন করে দেশি নীল রবিন পাখির বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে ‘লুসিনিয়া ব্রুনিয়া’। লুসিনিয়া গণের ১১ প্রজাতির পাখির মধ্যে পাঁচটিই বাংলাদেশে বিরল শীতের আগন্তুক: সাইবেরীয় চুনিকণ্ঠী, ধলা লেজ চুনিকণ্ঠী, লাল গলা ফিদ্দা, নীল গলা ফিদ্দা ও দেশি নীল রবিন।
দেশি নীল রবিনের মতো পরিযায়ী পাখির দৃষ্টিতে আমাদের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানটি নিঃসন্দেহে ঢাকা নগরের ভয়াবহ কংক্রিটের মরুভূমিতে ২০০ একরের লোভনীয় এক সবুজ মরূদ্যান। এখানে ইতিপূর্বে গ্রীষ্মের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি ‘খয়রাপাখ পাপিয়া’ দেখা গেছে। দেশের বিরল পাখি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য বাগানটি যে কত মূল্যবান, তা দেশি নীল রবিনের আগমনে আরেকবার প্রমাণিত হলো। দেশের পাখিপ্রেমীদের প্রত্যাশা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের মালিক হিসেবে বন বিভাগ এবং বন্য প্রাণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর যথাযোগ্য মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে।

ইনাম আল হক || প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment